ডার্ক সাইকোলজি ও NLP: এআই (AI) কীভাবে আপনার মস্তিষ্ক হ্যাক করছে?

জানুন কীভাবে ডার্ক সাইকোলজি ও NLP ব্যবহার করে এআই (AI) এবং স্ক্যামাররা আপনার মস্তিষ্ক হ্যাক করছে। Anchoring, Mirroring, এবং Embedded Commands-এর মতো ৫টি গোপন কৌশলের কেস-স্টাডি ও বাঁচার উপায় নিয়ে বিস্তারিত।

ডিসেম্বর 22, 2025 - 00:15
ডিসেম্বর 22, 2025 - 00:10
 0  3
ডার্ক সাইকোলজি ও NLP: এআই (AI) কীভাবে আপনার মস্তিষ্ক হ্যাক করছে?
ডার্ক সাইকোলজি ও NLP: এআই (AI) কীভাবে আপনার মস্তিষ্ক হ্যাক করছে?

আমার আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ডার্ক সাইকোলজিতে NLP’ -এর ব্যবহার নিয়ে। NLP মানে হচ্ছে, ‘Neuro-Linguistic Programming’বর্তমানে সাধারণত ‘এআই (AI)’ কে আরো বেশি উন্নত করতে এই ‘NLP’ -এর গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘদিন ধরেই NLP’ বিভিন্ন টেকনোলজিতে ব্যবহার করা হত মানে হুবহু মানুষের চিন্তাকে বুঝে ওঠা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য। সোজা বাংলায়, ChatGPT, DeepSeek এ যে ‘Reasoning’ অপশন দেখছেন এটাই NLP; যা মানুষের মস্তিষ্কের মত করে কাজ করতে চেষ্টা করে

 

উদাহরণস্বরূপ: গুগলে সার্চ করার সময় যখন আপনি টাইপ করছেন, “How to”, গুগল তাৎক্ষণিক ভাবে আপনার আগ্রহের বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে এবং সাজেশনে আপনার আগ্রহ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেতে পারে। আপনি যদি আর্থিক সংকটে ভোগেন তাহলে প্রথমে সাজেশনে আসতে পারে, “How to earn money”

 

কিন্তু ‘এআই’ এর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ঘাতক রুপ ধারণ করেছে। প্রথমত, ‘এআই (AI)’ এর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং আমাদের নির্ভরশীলতা। ChatGPT -এর মত এআই সরাসরি আপনার ইনপুট করা ডাটা মেমোরি হিসেবে সংরক্ষণ করছে এবং পরবর্তী প্রশ্ন করার সময় আপনার পূর্বের ডাটা বা তথ্য বিবেচনায় নিচ্ছে এবং একজন মানুষের মত আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। এই বিষয়টিকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই দেখা যেতে পারে

 

আমি ধাপে ধাপে এই জটিল বিষয়টিকে ব্যখ্যা করবো,

 

১. Anchoring: কোনো নির্দিষ্ট শব্দ, স্পর্শ বা সংকেতের মাধ্যমে কারও মনে শক্তিশালী আবেগ বা প্রতিক্রিয়া বাঁধা। যেমন: কারও মনে ‘অপরাধবোধ’ জাগিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা

২. Mirroring & Matching: অন্যের ভাষা, ভঙ্গি বা কণ্ঠস্বর নকল করে দ্রুত বিশ্বাস অর্জন। এটি ব্যবহার করে প্রতারকরা নিজেদেরকে আপনার মতো মানুষ হিসেবে আপনার কাছেই উপস্থাপন করে

৩. Embedded Commands: কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নির্দেশ দেওয়া। যেমন: “আপনি হয়তো এখনই বুঝতে শুরু করবেন যে, আমি যা বলছি সেটাই সঠিক।” — এখানে “বুঝতে শুরু করবে” একটি লুকানো নির্দেশ

৪. Pacing & Leading: শুরুতে সত্যি কিছু বলে বিশ্বাস অর্জন (Pacing), তারপর মিথ্যা বা বিপজ্জনক নির্দেশ দেওয়া (Leading)

৫. Language Ambiguity: দ্ব্যর্থক বা ধোঁয়াশা ভাষা ব্যবহার করে কারও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা ঝুলিয়ে রাখা

 

নিচে প্রতিটি প্রযুক্তির (Anchoring, Mirroring & Matching, Embedded Commands, Pacing & Leading, Language Ambiguity) সাম্প্রতিক গবেষণা, বাস্তব কেস-স্টাডি এবং আদালত-রেকর্ড-যুক্ত উদাহরণ সহ ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করা হলো। সমস্ত তথ্য ২০২৩-পরবর্তী অ্যাকাডেমিক পেপার, ল’ জার্নাল ও নিউজ-ডকুমেন্টেশন থেকে সংগৃহীত

 

১. Anchoring (অ্যাঙ্করিং)

ধাপ ১ – ট্রিগার নির্বাচন: ২০২৪-এর ‘Journal of Consumer Psychology’ -এ প্রকাশিত এক স্টাডিতে দেখা যায়, ই-মেইল স্ক্যামাররা প্রথম ক্লিকের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট হেক্স-কালার (#FF4C4C) ব্যবহার করে; এই রঙ মানুষের মনে ‘জরুরি-ঝুঁকি’ অ্যাঙ্কর তৈরি করে

ধাপ ২ – আবেগ-সংযুক্তি: ইউএস ফেডারেল ট্রেড কমিশন (FTC) ২০২৩-এর রিপোর্টে উল্লেখ করে, “Your account will be suspended” শব্দগুচ্ছের সঙ্গে রঙটির পুনরাবৃত্তি করলে ৪২% ব্যবহারকারী ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে লিংকে ক্লিক করে

ধাপ ৩ – রিমোট ফায়ারিং: একবার এই কালার-ট্রিগার মনে স্থাপিত হয়ে গেলে, পরবর্তী যেকোনো ই-মেইলে শুধু ‘#FF4C4C’ রঙের থাম্বনেইলটি দেখেই ব্যবহারকারীর মনে পুনরায় একই আবেগ জেগে ওঠে, যা যৌক্তিক চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে

 

উদাহরণ: ২০২৩-এর নর্থ-ক্যারোলিনা কোর্ট কেস (State v. Ridgeway) -এক সাইবার-অপরাধী প্রতি তিনটি ‘late-fee’ ই-মেইলে একই রঙের বাটন ব্যবহার করে ৭৪ বছর বয়সী একজনকে ৫০,০০০ ডলার খোয়াতে বাধ্য করে। রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, “The defendant weaponized color-anchoring to bypass rational scrutiny.”

 

২. Mirroring & Matching (মিররিং ও ম্যাচিং)

ধাপ ১ – ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট কপি: ২০২৪-এর ‘Computers in Human Behavior’ স্টাডিতে দেখা যায়, ফেসবুক মেসেঞ্জার-বটগুলো প্রথম ১০টি বার্তায় ইউজারের ইমোজি-ফ্রিকোয়েন্সি ৯৭% পর্যন্ত নকল করতে পারে, যা দ্রুত একটি অদৃশ্য সম্পর্ক স্থাপন করে

ধাপ ২ – ভয়েস-ক্লোনিং: ElevenLabs’ -এর ২০২৩-এর কেস-স্টাডি অনুযায়ী, মাত্র ৩০ সেকেন্ডের ভয়েস স্যাম্পল থেকে কণ্ঠস্বর রি-ক্রিয়েট করে কল-সেন্টার স্ক্যামাররা ৮৫% ক্ষেত্রে ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে

ধাপ ৩ – ট্রাস্ট-এস্কেলেশন: ভাষা ও কণ্ঠ মিলে গেলে শিকারের মস্তিষ্ক একটি শক্তিশালী ‘in-group’ সিগন্যাল পায়, যার ফলে প্রতারকের প্রতি আস্থা দ্রুত বৃদ্ধি পায়

 

উদাহরণ: ২০২৩-এর এফবিআই আইসি-৩ রিপোর্ট অনুযায়ী, একজন সিইও-র কণ্ঠ নকল করে CFO-কে ২.৪ মিলিয়ন ডলারের একটি ‘জরুরি ওয়্যার ট্রান্সফার’ করাতে বাধ্য করা হয়। পেমেন্ট-ব্যাংকের লগ থেকে জানা যায়, কণ্ঠের ধ্বনি-প্যাটার্ন ৯৯.১% পর্যন্ত মিলে গিয়েছিল

 

৩. Embedded Commands (এমবেডেড কমান্ডস)

ধাপ ১ – কমান্ড ফ্রেমিং: ‘Hypnosis & Cognition’ জার্নাল (২০২৪) দেখিয়েছে, ২-৪ শব্দের একটি কমান্ডকে ১৫-শব্দের একটি দীর্ঘ বাক্যের মাঝে স্থাপন করলে শ্রোতার প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স সেগুলোকে ‘স্বতন্ত্র নির্দেশ’ হিসেবে ফিল্টার করতে পারে না

ধাপ ২ – টোনাল মার্কার: কমান্ডটির ওপর ১২% বেশি ভলিউম বা ০.২ সেকেন্ড দীর্ঘ উচ্চারণের মতো সূক্ষ্ম টোনাল মার্কার ব্যবহার করা হয়, যা অবচেতন মনকে সরাসরি প্রভাবিত করে

ধাপ ৩ – অটো-কমপ্লায়েন্স: ল্যাব-টেস্টে দেখা গেছে, ৭৪% প্রাপ্তবয়স্ক সাবজেক্ট নির্দেশটি পালন করে এবং পরে মনে করে যে, এটি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল

 

উদাহরণ: ২০২৩-এর ‘UK Insolvency Service’ কেস – এক ডেব্ট-রিলিফ কোম্পানি ইউটিউব বিজ্ঞাপনে বলে, “You may suddenly realize that the smartest move is to click the link below right now.” এই কৌশলের ফলে ৬ সপ্তাহে ১,২০০ জন ‘voluntarily’ IVA-তে সই করেন, যদিও পরে অধিকাংশই দাবি করেন, “আমি নিজেই ভেবেছিলাম এটাই সেরা পথ।

 

৪. Pacing & Leading (পেসিং ও লিডিং)

ধাপ ১ – পেসিং: FTC-র ২০২৪ ‘Scam Trend Report’ অনুযায়ী, ৯৩% রোমান্স-স্ক্যাম শুরু হয়,I know online dating can be exhausting” -এর মতো কোনো সত্যি ও সহানুভূতিমূলক বাক্য দিয়ে, যা ভিকটিমের বাস্তবতার সাথে তাল মেলায়

ধাপ ২ – লিডিং: বিশ্বাস অর্জনের পরই প্রতারক তার মূল লক্ষ্যে প্রবেশ করে, যেমন: “But if you just help me with this customs fee today, we can finally meet tomorrow.”

ধাপ ৩ – সামঞ্জস্যতা-ট্র্যাপ: একবার শিকার প্রথম সত্যটি মেনে নিলে, পরবর্তী মিথ্যাটি অস্বীকার করলে তার মনে ‘কগনিটিভ ডিসন্যান্স’ বা মানসিক অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়। এই অস্বস্তি এড়াতে সে নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে পরবর্তী richiesta’ (একটি ইতালীয় শব্দ, যার অর্থ হলো অনুরোধ, চাহিদা, বা আবেদন) মেনে নেয়

 

উদাহরণ: ২০২৩-এর অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্টের একটি কেসে দেখা যায়, একজন ৬৭ বছর বয়সী নাগরিক ১৮ মাসে ৭৩০,০০০ AUD পাঠান। চ্যাট-লগে প্রতিবার টাকা চাওয়ার আগেই স্ক্যামার তার ‘একাকীত্ব’ ও মানসিক কষ্টের কথা স্বীকার করে নিত

 

৫. Language Ambiguity (ভাষার দ্ব্যর্থকতা)

ধাপ ১ – সিমান্টিক ডাবল-এন্ট্রি: আর্থিক পণ্যে ‘guaranteed growth’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা একই সাথে ‘মূলধন বৃদ্ধি’ বা নিছক ‘পিরিয়ডিক বোনাস’ দুটিই বোঝাতে পারে

ধাপ ২ – সিনট্যাক্টিক ক্লাউড: দীর্ঘ, একাধিক সাব-ক্লজ-যুক্ত জটিল বাক্য মস্তিষ্কের working memory’ -কে ওভারলোড করে, যার ফলে মূল শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না

ধাপ ৩ – ইন্টারপ্রিটেশন হাইজ্যাক: এই পরিস্থিতিতে শিকার তার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অর্থটি বেছে নেয়, অন্যদিকে প্রতারক আইনি দায় এড়াতে সক্ষম হয়

 

উদাহরণ: ২০২৩-এর SEC v. ForexHub LLC কেসে কোম্পানিটি দাবি করে, “Client funds are held in segregated accounts with institutional-grade security.” বাস্তবে, ‘Segregated’ বলতে এমন এক অফশোর এন্টিটিকে বোঝানো হয়েছিল, যেখানে ক্লায়েন্টের টাকা কোম্পানির নিজস্ব অ্যাকাউন্টের সাথে মিশে যেত। বিচারে প্রমাণিত হয়, এই ভাষার দ্ব্যর্থতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল এবং কোম্পানিকে ৩.৮ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়

 

প্রতিটি কৌশলই ব্যবহারকারীর সাব-কনশাস প্রসেসকে ওভাররাইড করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। আদালতের সাম্প্রতিক রায় ও পিয়ার-রিভিউড গবেষণা প্রমাণ করে যে, এই পদ্ধতিগুলো এখন ভয়ংকরভাবে স্কেল-আপ হয়েছে—ফোন-ক্লোনিং থেকে শুরু করে রঙ-ট্রিগারড ই-মেইল পর্যন্ত

 

এক্ষেত্রে সচেতনতার একমাত্র কার্যকর নিয়ম হলো: কোনো অনুভূতি যদি ‘অতি-সহজে’ বা কৃত্রিমভাবে তীব্র মনে হয়, তবে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করা এবং নিজেকে প্রশ্ন করা যে, “এই চিন্তাটি কি আমার নিজস্ব, নাকি কেউ আমার ভেতরে একটি সুইচ টিপে দিয়েছে?”

আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

পছন্দ পছন্দ 0
অপছন্দ অপছন্দ 0
ভালোবাসা ভালোবাসা 0
মজার মজার 0
রাগান্বিত রাগান্বিত 0
দুঃখজনক দুঃখজনক 0
চমৎকার চমৎকার 0
মোঃ মেহেদি হাসান আমার পুরো নাম: মোঃ মেহেদি হাসান। কলম নাম: মি. বিকেল। আমি ‘অভিযাত্রী (Oviyatri)’ ওয়েবসাইটের প্রধান সম্পাদক ও পরিচালক। আমি পেশায় একজন লেখক ও ব্লগার। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ন করেছি। আমার লেখা প্রথম বই ‘জোনাকিরা সব ঘুমিয়ে গেছে (ছোট গল্প সংকলন)’ প্রকাশিত হয় গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ সালে ভারতে এবং ১ম জানুয়ারী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে। বইটি বর্তমানে রকমারি.কম -এ উপলব্ধ। বর্তমানে আমি একটি স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত আছি। এছাড়াও আমি মাইক্রোসফটে ডেভেলপার প্রোগ্রামে গত ২০২৩ সালের জানুয়ারী মাস থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আমি গত ২৫ আগস্ট, ২০২১ সালে ‘দ্য ব্যাকস্পেস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি। বর্তমানে এই ওয়েবসাইট পরিচালিত হচ্ছে ‘দ্য ব্যাকস্পেস’ প্রতিষ্ঠানের টিম কতৃক। আমার সম্পর্কে বা আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অথবা, আমাদের সাথে কাজ করার আগ্রহ থাকলে যোগাযোগ করুন: [email protected] -এই ঠিকানায়। অভিযাত্রীতে আপনাকে স্বাগতম! (License notice - applies to this profile photo only: This photo is licensed under the Creative Commons Attribution-ShareAlike 4.0 International (CC BY-SA 4.0). License: https://creativecommons.org/licenses/by-sa/4.0/, Attribution: MD Mehedi Hasan, Source: https://oviyatri.com/profile/mrbikel)