শৃঙ্খলা নাকি শৃঙ্খল? ‘সময়ের উপনিবেশবাদ’ ও আমাদের তথাকথিত ‘আঙ্কেল সমাজ’
শৃঙ্খলা মানেই কি সকাল ৯টায় অফিস আর ৩০ বছরে বিয়ে? নাকি এটি ‘আঙ্কেল সমাজ’-এর চাপিয়ে দেওয়া এক অদৃশ্য শিকল? জানুন কীভাবে ‘সময়ের উপনিবেশবাদ’ আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লক ও সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করছে।
আমাদের হাতে থাকা ঘড়ি বিজ্ঞানের আবিষ্কার হতে পারে কিন্তু সেটা আমাদের ‘শৃঙ্খলা (Discipline)’ হতে পারে না। আমাদের বায়োলজিকাল ক্লকের সাথে আমাদের হাত ঘড়ির সম্পর্ক খুবই যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয়।
আমরা নিজেদের উপর চাপিয়ে দিই যে, আমাদের সকাল ৯টা বা সকাল ১০টা থেকে কাজ করা উচিত। ঘড়ি সংখ্যা জানায়, আমরা কাজ শুরু করি, এবং আমরা আমাদের নিজ শরীর থেকে অনুমতি নিই না।
আমরা চিন্তা করি না যে, “ঐ সময়ে আমার শরীরটা প্রস্তুত থাকবে তো?” আমরা শুধু সংখ্যা দেখি এবং মেনে নিই। আর ওটাকেই এক পর্যায়ে নাম দিই ‘শৃঙ্খলা’; যা মূলত একধরণের ‘শৃঙ্খল’ এবং এক ধরণের ‘সময়ের উপনিবেশবাদ’। শুরু থেকেই সেখানে যে ‘শৃঙ্খলা’র সরব ছিলো তা আস্তেধীরে ‘শৃঙ্খল’-এ পরিণত হয়।
আপনি দেখতে পাবেন, আপনি দিনের পাঁচ বেলায় যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন সেটাও একধরণের ‘শৃঙ্খলা (Discipline)’। কিন্তু ধর্ম ব্যতীত চিন্তা করলে সেটাও এক ধরণের শৃঙ্খল অথবা, এক ধরণের দায়বদ্ধতা। আবার এমন নয় যে, ইসলাম ধর্ম-ই শুধু এমন শৃঙ্খলার কথা বলেছে। আপনার ইচ্ছামত যেকোনো একটি ধর্ম চিন্তায় নিন দেখবেন সেখানেও একই ধরণের শৃঙ্খলার বিষয়টি স্পষ্ট।
কিন্তু আমি এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের কাকা/চাচাদের দেওয়া ‘শৃঙ্খলা (Discipline)’ -এর সংজ্ঞা বুঝতে। ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা নয়। আমাদের শেষ পর্যন্ত বের করতে হবে, আসলে শৃঙ্খলা কি? কীভাবে শৃঙ্খলা আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় ‘শৃঙ্খল’ হয়ে গড়ে উঠেছে?
আপনি সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠতে না পারলে আপনি ‘অলস’। দিনে অন্তত ঘড়ি ধরে আট-দশ ঘন্টা কাজ করতেই হবে। কিন্তু এই মানদন্ড কে ঠিক করলো? আঙ্কেল সমাজ। আমাদের আঙ্কেল সমাজের ‘শৃঙ্খলা’ নিয়ে যেসব ধারণা রয়েছে সেসব বড়ই বিচিত্র। একটা পুরো সমাজ, এখন পর্যন্ত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে খুব সকালে উঠতে পারলেই আপনি নিয়মানুবর্তী মানুষ। আপনি শৃঙ্খলার প্রেমে পড়েছেন।
বাংলাদেশে শৃঙ্খলা হলো, একটি সুনির্দিষ্ট চাপিয়ে দেওয়া পরিকাঠামো। যেখানে শুধু সকালের সময় বলে দেওয়া হয় নাই, বলে দেওয়া হয়েছে যে, “আপনি কখন বিয়ে করবেন? আপনি কখন চাকুরী করবেন? এবং আপনি কখন বাচ্চা নেবেন? ইত্যাদি ইত্যাদি” – মানে আপনি কতভাবে পরাধীন হবেন তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো।
এই চাপে একটা বাচ্চার জায়গায় তিনটে জন্মালেও ‘শৃঙ্খলা’ খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং আমরা একটি প্রোডাকশন মেশিন হিসেবে নিজেদের খুঁজে পাইলেও পাইতে পারি।
আবার ধরুন, আপনার বয়েস ৩০ পার! কিন্তু সিকিউর একটা চাকুরী জুটলো না! হায় হায়… এই ব্যর্থতা যতটা আপনার তারচেয়েও বড় ব্যর্থতা হলো আঙ্কেল সমাজের। এখানে ‘আঙ্কেল সমাজ’ একটি সিস্টেম আর আপনি হলেন তাদের ধারণা অনুযায়ী তাদের সিস্টেমে একটি ‘ডিফেক্টিভ ইউনিট’।
মনে রাখবেন, একটি পরিবার যতবেশি শৃঙ্খলার বয়ান ঝাড়ে ঐ পরিবার মূলত ততবেশি পরাধীন ও নিশ্চুপ থাকা টাকে বেছে নেয়। আবার এদেরই জাতীয় কবি হলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। যিনি চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলার ধার কখনোই ধারতেন না, মানতেন না।
কবি লিখছেন,
“আদি শৃঙ্খল সনাতন শাস্ত্র-আচার
মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার!”
— কাজী নজরুল ইসলাম, জাগো (১৯২২)
তিনি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন, প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা সব শৃঙ্খল, পুরোনো শাস্ত্র, ধর্মীয় রীতি-নীতি, সামাজিক কঠিন নিয়ম এসবই আমাদের সর্বনাশের মূল কারণ; আজ আমি এই শৃঙ্খল ভেঙে ফেলব।
এখানে, ‘Irony’ হলো শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতির জাতীয় কবি নজরুল! অবশ্য, আমার আজকের আলোচনা কিন্তু ‘শৃঙ্খলা (Discipline)’ -এর সংজ্ঞা নিয়ে, ঠিকাছে? কবি বা কাব্য সংক্রান্ত কিছু নয়।
পরিবার শৃঙ্খলা কে সবসময় “মানুষ কি বলবে?” -এই প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে নিজেই নিজেদের মধ্যে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। কারণ আমাদের আঙ্কেল সমাজ হচ্ছে তার সিস্টেম বা ধারক। আর এসব ঘিরে বেড়ে ওঠা যাবতীয় প্রতিষ্ঠান হলো একেকটি শৃঙ্খল পরানোর অজুহাত।
আর একটি রাষ্ট্র যখন বুঝতে পারে, আমরা এত বোকা হয়ে পড়েছি তখন সে কিন্তু মোটামুটি যা ইচ্ছে তাই আমাদের গেলাতে সক্ষম হয়ে পড়তে পারে। কারণ আমাদের কাছে আজও সুনির্দিষ্ট বা পরিষ্কার শৃঙ্খলার সংজ্ঞা নাই।
আপনি খুবই শিক্ষিত মানুষকে একবার জিজ্ঞেস করবেন, “জনাব শৃঙ্খলার সংজ্ঞা কি?” খুব সম্ভবত আপনি উত্তর পাবেন না আর যদি ভাগ্যক্রমে পেয়েও যান তাহলে সেটা শুনে খুবই হতাশ হবেন।
প্রশ্ন হলো, শৃঙ্খলার সংজ্ঞা না জানলে কি ক্ষতি হবে? ভালো প্রশ্ন। আপনি যদি শৃঙ্খলার সংজ্ঞা না জানেন তাহলে অন্তত দুটি গুরুতর সমস্যা তৈরি হবেই —
১. যে-কেউ যে-কোনো সময় বলে দিতে পারে, “আপনি একজন অশৃঙ্খল মানুষ!”
২. যে-কেউ যে-কোনো নিয়ম তৈরি করে বলতে পারে, “জনাব, এটাই শৃঙ্খলা!”
সংজ্ঞা না থাকলে দোষারোপের ঠিকানা হয় ঘড়ির সংখ্যা। আপনি ১০টায় উঠতে না পারলেই নিজেকে বলেন, “আমি অলস!” একটা কৃত্রিম অপরাধবোধ তৈরি হয়, যা স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল) বাড়ায়, ঘুমের চক্র ভাঙে, ইমিউন সিস্টেম কমে। ফলাফল হলো, প্রকৃত অলসতা নয়, প্রকৃতি-বিরোধী টাইম-টেবিলের দাসত্ব।
আবার সংজ্ঞার অভাবে রাষ্ট্র বা কর্পোরেট যখন খুশি নতুন নিয়ম ছুঁড়ে দেয়। ওভারটাইম বাধ্যতামূলক, ছুটি কমানো, ৬ দিন অফিস। আপনি প্রতিবাদ করার ভাষা পান না। কারণ আপনার কাছে শৃঙ্খলা মানে “মেনে চলা”, “না মেনে চলা” মানে অশৃঙ্খল।
এতে রাষ্ট্র/বাজারের খরচ কমে, আপনার শ্রম-মূল্য কমে, স্বাস্থ্যবিল বাড়ে কিন্তু দায় আপনার ওপর চাপে। কারণ তখন আপনাকে ভাবানো হয়, “আপনি শৃঙ্খলা রাখেননি!”
সুতরাং প্রশ্ন করতে থাকুন, সবসময়, নিজেকে, “শৃঙ্খলা (Discipline)’ আসলে কী?”
ফুটনোট: এই প্রবন্ধে ‘সময়ের উপনিবেশবাদ’ ও ‘আঙ্কেল সমাজ’ একটি দার্শনিক প্রেক্ষাপট। সরাসরি আপনার পাশের বাড়ির আঙ্কেল কে বুঝানো হয় নাই।
আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
পছন্দ
0
অপছন্দ
0
ভালোবাসা
0
মজার
0
রাগান্বিত
0
দুঃখজনক
0
চমৎকার
0